শিখর ছোঁয়ার নেশায় – ৪

Abokash > Blog > শিখর ছোঁয়ার নেশায় – ৪

(১৪)

গরুবাথান পেরিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের যে সুউচ্চ চূড়া দেখে মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম, তারই মাথায় উঠে এসেছি এখন। সূর্য্যি মামা আজ আর দেখা দেবেন বলে মনে হল না। এখান থেকে নিচের দিকটা প্রায় আচ্ছন্ন ধূসর কুয়াশায়। তার অস্বচ্ছ চাদরের ফাঁক গলে যেটুকু চোখে পড়ল সেটিও অনেক বেশিই পাওনা বলে মনে হল আমাদের। প্রায় ৫০০০ ফুট উঠে এসেছি এখন। নিচের উপত্যকার নদীটি সরু ফিতের মতো পড়ে আছে আর দুই পাশের ঢালে ঘরবাড়িগুলি দেখাচ্ছে দেশলাইয়ের বাক্সের মতো।

পথের বাঁকে চওড়া মতো একটি জায়গায় দুটি দোকানঘরের সামনে দাঁড়ানো ব্যাগপত্র বোঝাই দুটি সাদা গাড়ী। সামনের ফাঁকা অংশে টেবিল পাতা। সেখানে প্রাতরাশে ব্যস্ত কিছু লোকজন। ওঁদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। পথ আবার সরু হয়ে এঁকে বেঁকে উঠেছে। কাঠের তৈরী একটি বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গায় বসা দুটি কিশোরী, গল্প থামিয়ে মুখ তুলে দেখল আমাদের গাড়িটিকে। অল্প দূরেই এক চিলতে ক্ষেতে পেট ভরাতে ব্যস্ত বড় একটি শূকর। রাস্তা এখানে বেশ মসৃণ ও পরিষ্কার। পাশের খাড়াই ঢালটি  ইঁট ও পাথর দিয়ে বাঁধানো, ওপরে তাকাতে কিছুই গোচরে এল না। বুঝলাম পাহাড়ের শিখরে এসে পৌঁছেছি। এতটা চড়াই উঠে সে বুঝি ক্লান্ত তাই হাঁফ নেবার জন্য গাড়ি থামল। নামলাম গাড়ি থেকে, পা টলমল করলেও সামলে নিয়ে উঁকি দিলাম খাদের কিনারায়।

A Foggy Road Enveloped by Pine Forest in Neora Valley National Park - Lava - Abokash images

ওঠার পালা শেষ করে গাড়ি কখন যে আবার নামতে শুরু করেছি বুঝিনি। খেয়াল হতে দেখলাম আগের পাহাড়ের চূড়া ছেড়ে নূতন পাহাড়ের চূড়ায়  পা দিয়েছি আমরা। আবার ওঠার সাথে সাথে পরিবেশের পরিবর্তন চোখে পড়ছিল খুব বেশি করে। পথ অনেকটাই প্রশস্ত এখানে, আর দুই ধার ঘন গাছপালায় ভরা। বৃষ্টির স্রোত নুড়ি মেশানো মাটির দলকে ধুয়ে নিয়ে এসে ফেলেছে কোথাও কোথাও। ঝাউ ও পাইনের ঘন জঙ্গলে মোড়া চড়াই উঠে গিয়েছে আরও উঁচুতে। জঙ্গলের মাথা ঘন কুয়াশায় ঢাকা। খাদকে বাম দিকে রেখে ছুটে চলেছি আমরা। কোনো প্রাগৈতিহাসিক যুগে এসে পড়েছি যেন। চির গোধূলীতে আচ্ছন্ন হয়ে সময় এখানে থমকে দাঁড়িয়ে। একটা মনোরম অথচ অজানা ভয়ে গাটা ছমছম করছে। সত্যিই কি জেগে আছি! নাকি ঘুমের মাঝে পৌঁছে গেছি “হ্যারি পটার” বা “হবিট” -দের দেশে। এ আমার চেনা বাংলা নয়, এ বাংলার রূপ আমি আগে দেখিনি, কল্পনাও করিনি কখনও স্বপ্নে। আমি মন্ত্রমুগ্ধ, আমি অভিভূত।

ঠান্ডা জাঁকিয়ে বসছিল চড়াইয়ে সাথে পাল্লা দিয়ে, ঘন কুয়াশার ভরা কনকনে বাতাসের ঝাপটা চোখে মুখে লাগতে বুঝতে পারছিলাম স্বপ্নে নয় ঘোর বাস্তবেই আছি। প্রায় ৭০০০ ফুট উঠে এসেছি এখন। এই ঘন জঙ্গলের ভেতর আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করে আছে তার আগাম কোন আঁচ -ই পাচ্ছিনা। এই ঝাউ, ওক আর পাইনের ঘন কালো জঙ্গল যেন সম্মোহিত করে রেখেছে আমাদের।

The dark pine forest covered with fog on the way to Lava in Neora Valley - West Bengal - Abakash images

(১৫)

লাভা! পাইন, ওক এবং ঝাউ গাছের ঘন জঙ্গলবেষ্টিত পাহাড়ের চূড়ায় একটি বৌদ্ধ গুম্ফাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গের অতি জনপ্রিয় এই জনপদটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ৭২০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই স্থানের সৌন্দর্য্য ভুলিয়ে দেয় যাবতীয় ক্লান্তি। শীতল সতেজ বাতাসের আঘ্রাণ শরীর ও মনে নিয়ে আসে এক অপার্থিব শান্তি। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় ক্ষণে ক্ষণেই বদলাতে থাকে রূপের চিত্রপট। নীল আকাশের নিচে কুয়াশাঘেরা পাহাড়ের অবয়ব, নাম না জানা পাখির একটানা শিস, মাঝে মাঝে বেজে ওঠা গুম্ফার চাপা ও ভারী ঘন্টার শব্দ শুনে কাটিয়ে নিশ্চিন্তে দেওয়া যায় অবকাশের কয়েকটা দিন। এখানকার মানুষদের ব্যবহার ও সহযোগিতা শেখায় ভালোবাসতে, জাগিয়ে তোলে ভ্রাতৃত্ববোধ।

মূলত মনাস্ট্রিকে কেন্দ্র করেই পর্যটনের শিখরে উঠেছে এই স্থান। পাহাড়ের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোট বড় থাকার ঘরবাড়ি, হোটেল ও রিসর্ট। স্থানীয় প্রায় সকল বাড়িতেই হোমস্টে থাকার ব্যবস্থা ছাড়াও সরকারি দুটি বনবাংলো আছে শহর ছাড়িয়ে একটু নিরিবিলিতে। আগে থেকে বুক না করা থাকলেও হঠাৎ আগত অতিথিদের সাদর আমন্ত্রণে কসুর করে না লাভা। দ্রষ্টব্যের কোনো কৃপণতা করেননি প্রকৃতি মাতা। নিজের হাতে ঢেলে সাজিয়েছেন সবকিছুই। প্রকৃতি নিরীক্ষণ করার জন্য নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার, নেওড়া ভ্যালির ঘন জঙ্গলে ট্রেক করে গিয়ে দেখা যায় হরেক প্রজাতির অর্কিড, পাখি, প্রজাপতি ও লাল পান্ডা। এ ছাড়াও বৌদ্ধ গুম্ফার আশ্চর্য কারুকার্য ও মূর্তি অসাধারণ… অসাধারণ!

The little mountain city view from golden-red-colored Buddhist Monastery at Neora valley - Kalimpong Tourism - Abakash images

রাস্তার দুই পাশে পোঁতা লম্বা লম্বা বাঁশের মাথায় চকচকে সাদা কাপড়ের চৌকো পতাকা। দমকা বাতাসে পতপত শব্দে উড়ছে সেগুলি। যেন বাঁশের বাঁধন ছাড়িয়ে তারা মুক্ত হতে চাইছে সেই কত কাল থেকে। জঙ্গলে মোড়া অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে সম্মোহিত হয়ে এগিয়ে চলছি। হঠাৎই সামনে বেশ বড় একটি জনপদ, কিছুটা অপ্রত্যাশিতই। নেওড়া ভ্যালির গহন অরণ্যের চূড়ায় যে এতবড় লোকালয় থাকতে পারে তা কল্পনাতেও ছিল না আমাদের। জঙ্গলের মায়াবন্ধন কাটিয়ে দুচোখ ভরে দেখতে থাকলাম পাহাড়ি শহরটিকে।

কাঠ ও কংক্রিটের তৈরী ঘরবাড়িগুলি পাহাড়ের ঢালে থরে থরে সাজানো। বাড়িগুলোর উঠোনে পাহাড়ি ফুলের রমরমা। পিচের রাস্তার একপাশে বাড়ির উঠোন ঠেসে দাঁড় করানো যাত্রী ও মালবাহী কিছু গাড়ী। আরও একটু এগোতে মূল শহরের মাঝে এসে মুখ হাঁ হয়ে গেল। একটুকরো এই জায়গায় গায়ে-গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ৩ থেকে ৬ তলা কংক্রিটের বাড়িগুলি। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন উঁচু বাড়িগুলির ছাদ। তাদের পিছনে বড় বড় তিনটি মোবাইলের টাওয়ার, আরও পিছনে ঢাল নেমে গিয়েছে নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে।

পাইন গাছের পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় ৫-৬ টি রাস্তার ধস সারাই করার ক্রেন অপেক্ষা করছে তাদের পরবর্তী কাজের জন্য। একটু নিচেই বড় একটি খেলার মাঠে চরে বেড়াচ্ছে বলদ গোছের একটি প্রাণী। ঘন কালো লোমে ভরা প্রাণীটি চেনা বলদের থেকে বেশ কিছুটা বড়, ইয়াক হলেও হতে পারে। ভাবার সাথে সাথেই ঘাড় নেড়ে সে সায় দিল মনের কথাটায়।

রাস্তার মাঝে কালো রঙের পাথর বসানো কংক্রিটের একটি ফলকে লেখা : ওয়েলকাম টু লাভা। ফলকটির মাথায় গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রিয় নেতার মুখ আঁকা তেরঙ্গা পতাকা টাঙানো। ফলকটিকে পাশ কাটিয়ে বাঁয়ে ঘুরলাম আমরা। সোয়া ১২টা। গাড়ি গিয়ে থামল লাভা স্কুলের সামনের পার্কিং-এ। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই কনকনে ঠান্ডা জাঁকিয়ে বসল সারা শরীরে। ঠান্ডার তীব্রতা এতো বেশি যে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলাম সকলে। গায়ে ওভারকোট চাপিয়ে সকলে চললাম এখানের বিশেষ আকর্ষণটিকে চাক্ষুষ করতে। আগে থেকে অর্ডার না করলে এখানে দুপুরের খাবার পাওয়া যায় না তাই সদনকে সেই দায়িত্বভার দেওয়া হল।

The beautiful lavender colored flowers blooming beside the Lava Monastery at Autumn's morning - Bengla Tourism - Abokash images

(১৬)

পাথর বাঁধানো প্রাচীরের ওপর একগোছা বেগুনী ও সাদা ভেলভেট রঙের পাহাড়ি ফুল হালকা বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। তাদের রূপে আকৃষ্ট হয়ে কোন স্থান থেকে এসে জুটেছে একটি মধুকর। উড়ে বেড়াচ্ছে এফুল থেকে অন্যফুলে। তাদের পার করে পৌছালাম লোহার রেলিং দেওয়া মস্ত এক ফটকের সামনে। আধখোলা ফটকের গায়ে সোনালী রঙের নানান কারুকার্য করা। ফটকটির ওপর ইংরিজিতে লেখা: KAGYU THEKCHENLING INSTITUTE। তার পাশের অজানা ভাষায় আরও কি সব লেখা। পাঠোদ্ধার করার সাহস হল না। উঁকি দিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে গটগটিয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে।

উঁচু একফালি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত গুম্ফাটি। তার চারপাশে চওড়া ঢালাইয়ের রাস্তা। পাহাড়ের গা কেটে বানানো হয়েছে রাস্তাটিকে। বাম দিকের খাদ নেমে গিয়েছে নেওড়া ভ্যালিতে। ডান দিকের পাহাড়ের ঢাল ভীষণ খাড়াই হয়ে উঠে গেছে ওপরে। খাদের ঢালে ইঁটের রেলিং আর তাদের মাথায় আগের মতোই চকচকে কাপড়ের বিভিন্ন রঙের লম্বা চৌকো পতাকা। চক্রাকার রাস্তাটি ঘুরে উঠে আসতে হল গুম্ফাটিতে। চারপাশের দৃশ্য অবর্ণনীয় সুন্দর। হিমালয়ের যে কয়টি স্তর গোচরে আসে এখান থেকে তাদের প্রত্যেকটি ঢাকা গাঢ় সবুজ ওক-পাইন-ঝাউয়ের ঘন জঙ্গলে। নীল আকাশ ঢেকে রয়েছে ধূসর মেঘে আর তাদের  ফাঁক গলে সূর্য্যি মামার উঁকি দেওয়ার মাঝেই কুয়াশা আস্তে আস্তে ছেয়ে ফেলছে পর্বতের চূড়াগুলিকে।

A lovely view of Lava Monastery in a shiny morning - Kagyu Thekchen Ling Monastery - Bengal Tourism - Abakash images

রাস্তার শেষে, চওড়া বাঁধানো ধাপের সিঁড়ি দিয়ে উঠেই মস্ত এক দালান। এখন থেকে প্রায় গোটা লাভা শহরটিকে দেখা যায়। দালানটির তিনদিকে তিনটি প্রাসাদসম বাড়ী। সামনের সোনালী টিনের চাল দেওয়া ঘন লাল রঙের বাড়িটি পাহাড়ের নিচ থেকে উঠে এসে মিশেছে দালানের সাথে। পাঁচতলা এই বাড়ির চতুর্থ ও পঞ্চম তলাতে সার সার বেঞ্চ পাতা। সম্ভবত শিক্ষানবিশ লামাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সেগুলি। বাড়িটির নিচের কক্ষগুলি বসবাসের জন্য। দোতলার বারান্দায় জামাকাপড় শুকোতে দিচ্ছে ছোট্ট দুটি লামা বালক। চোখে চোখ পড়তেই টুক করে ঢুকে পড়ল পাশের ঘরে।  যেন কিছু অযাচিত ভাবেই সামনে চলে এসেছে খুদে গুলো।

দালানটির ডানদিকে গাঢ় লাল ও কমলা রঙের প্রার্থনা ঘর। তার পিছনে বেশ বড় দুটি বাড়ী ও তাদের পিছনে কিছুটা উঁচুতে আরও একটি বড় বাড়ী। সোনালী রঙের এই বাড়িগুলির সামনে বাগানে ফুটে রয়েছে লাল, গোলাপী, হলুদ, কমলা, বাদামী, সাদা ও আরো হরেক রঙের নাম না জানা ফুল। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি, ফড়িং। ধাপ দিয়ে উঠে, চওড়া বারান্দা পেরিয়ে ঢুকতে হয় প্রার্থনা কক্ষে। বারান্দার দেওয়াল ও সিলিং-এ সর্বত্র লাল, নীল, সোনালী, হলুদ রঙের বিভিন্ন নক্সা করা। প্রার্থনা কক্ষটি বেশ বড়, ঘরের দুপাশে চারটি বড় বড় জানালা। সামনে ধ্যানরত বুদ্ধের বিরাট মূর্তির পশে বসানো পরবর্তী ধর্মগুরুদের মূর্তি। তার নিচে সাতটি বাটিতে রাখা জলের পাত্রের মাঝে সদা প্রজ্বল একটি প্রদীপ।

বামদিকের গাঢ় খয়েরি রঙের চারতলা বাড়িটির নিচের তলায় অতিথিদের বসার জায়গা। তার ওপরের তলাটি দালানের সাথে একই সরলরেখায় অবস্থিত। এখানেও ভগবান বুদ্ধের সাথে তাঁর পরবর্তী ছয় ধর্মপ্রচারকদের মূর্তি। প্রত্যেকেই ধ্যানরত। মোটা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো দলাই লামার একটি ছবি টাঙানো দেওয়ালে । এখানেও প্রতিটি মূর্তির সামনে সাতটি পাত্রে জল রাখা আর তাদের মাঝে একটি প্রদীপ জ্বলছে টিমটিম করে। কক্ষটির ভেতর বিরাজ করছে অদ্ভুত শান্তির পরিবেশ। ভক্তিভরে হাত জোড় করে ভগবান বুদ্ধের আশীর্বাদ চেয়ে নেমে এলাম নিচে।

Neora valley covered with the fog from Lava Monastery - West Bengal Tourism - Abakash images

(১৭)

মনাস্ট্রি থেকে বেরিয়েই ডান দিকের রাস্তায় ঢাল বেয়ে একটু উঠলেই পর পর অনেকগুলি হোটেল। তাদের একটিতেই আমাদের আহারাদির ব্যবস্থা করে রেখেছে সদন। হোটেলগুলি মূলত পরিচালনা করেন বাড়ির মালিক ও মালকিনরা। নিজেরাই রান্না ও পরিবেশন করেন আগে থেকে অর্ডার দেওয়া গরম গরম সুস্বাদু খাবার। ছোট্ট দুই-তিন তলা বাড়ির নিচের তলায় হোটেল ঘরের সাথে ষ্টেশনারী দোকান আর ওপরের দুটি তলাতে হোম-স্টের ব্যবস্থা। স্থানীয় মানুষজন মূলত পর্যটনকে কেন্দ্র করেই তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করেন এখানে।

ঠাসাঠাসি করে পাতা তিনটি টেবিলে বসে খাওয়া-দাওয়া করছে পুরুষ ও মহিলা মিলিয়ে জনা বারো। তাদের পরিবেশনে ব্যস্ত দুইজন মহিলা। হোটেল লাগোয়া আরও একটি দোকান ঘরে বিক্রির সাজানো হরেক রকমের প্রসাধনী দ্রব্যসামগ্রী। পার্শ্ববর্তী সব হোটেলের চেহারাও খানিক একই। সবগুলির সামনেই ভিড় করে দাঁড়িয়ে লোকজন। একটি টেবিলে বসলাম আমি, সুমনা, সুনীল ও পাপিয়া। অন্যটিতে শোভন, সীমা ও সানা।

পাতিলেবু, লঙ্কা ও স্যালাড দিয়ে সাজানো প্লেট পরিবেশন করা হল টেবিলে। সাথে সরু চালের ভাত, ঘন বিউলির ডাল, স্কোয়াশ ও বাঁধাকপির ঘন্ট এবং চিকেন কষা। গরম বাষ্প বেরুচ্ছে খাবারগুলি থেকে। দুপুর প্রায় ১:৩০। ক্ষিদেও পেয়েছিল খুব। ভীষণ সুস্বাদু খাবার ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশনা। জমিয়ে শুরু হল ভুরিভোজ। শেষ পাতে চাটনি ও আঁচে সেঁকা মশলা পাঁপড় রসনা তৃপ্তি করল আমাদের। খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে।

মাথায় হলুদ ফেট্টি, সোনালী পাটিয়ালা ও লাল পাঞ্জাবীর ওপর ধূসর রঙের ওভারকোট পরিহিত দুইজন সাধু দাঁড়িয়ে হোটেলটির সামনে। বড় বড় দুটি রুদ্রাক্ষের মালা তাঁদের গলায়। কাঁধের বড় ঝোলা থেকে উঁকি দিচ্ছে শীতের পোশাক। খানিক এদিক ওদিক তাকিয়ে ঢাল বেয়ে উঠে গেলেন ওপরে। পাহাড়ি অলংকার ও শীতের পোশাকের সম্ভার সাজানো পাশের দোকানে। সকলে মিলে ঢুকে পড়লাম সেখানে। রং-বেরঙের হাজারো পুঁতির মালা, তামার তৈরি বৌদ্ধ অলংকার, দেবদেবীর মূর্তি, পাত্র ও পোশাকের বিপুল সম্ভার। খানিক নাড়াচাড়া, দরদাম ও কিছু কেনাকাটি করে ফিরে এলাম গাড়িতে।

Local grocery shops selling the bright symbolic chimes and idols of Lord Buddha at Lava - Kalimpong - Abokash images

(১৮)

আমরা যখন রওনা দিলাম আমাদের শেষ গন্তব্যের দিকে ঘড়িতে তখন তিনটে। ঠাণ্ডা বাড়ার সাথে সাথে ধূসর কুয়াশার ঘনত্ব আরও কিছুটা গাঢ় হয়েছে। দূরের পাহাড়ের চূড়াগুলো আরও বেশি অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এখন। লাল লাভা মনাস্ট্রিকে পিছনে ফেলে রিজার্ভারের পাশ দিয়ে কাঁচাপাকা রাস্তায় ছুটে চললাম আমরা। লাভা পেরিয়ে আবার গিয়ে পড়লাম পাইন-ওক-ঝাউয়ের জঙ্গলে।

পাহাড়ের এই অংশের রাস্তা বেশ চওড়া হলেও ধসে গিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। ঘন জঙ্গলে মোড়া আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে চলেছি আমরা। কিছুটা এগিয়েই রাস্তা নিচু হয়ে নেমে গিয়েছে ছোট্ট একটি উপত্যকায়। বিরাট বড় পাহাড়ের পাদদেশে আট-দশটি ঘরবাড়ির সামনে খেলা করছে কিছু ছেলেমেয়ে। পাশের ছোট গুমটি দোকানের সামনে গুটিচারেক চেয়ারে বসে গল্পে ব্যস্ত চারজন মহিলা।

রাস্তা এখানে দু-ভাগে ভেঙে একটি ডানদিকে উঠে গিয়েছে ঘন পাইন আর ওকের জঙ্গলে আর অন্যটি বামে বেঁকে নেমে চলে গিয়েছে কালিম্পঙের দিকে। ডানদিকের রাস্তাটি ধরলাম আমরা। নুড়ি কাঁকর বিছানো রাস্তায় পিচের অবশিষ্ঠ্যাংশও দুর্লভ এখন। যে জঙ্গলের ধার ঘেঁষে চলে এসেছি এতক্ষন তার মাঝে প্রবেশ করলাম এবার।

প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন সরু রাস্তাটি মোড়া মোটা মোটা পাইন আর ঝাউ গাছে। বিশাল সেই অরণ্যানীর ভেতর দিয়ে অতি ক্ষুদ্র আমরা কয়েকটি প্রাণী পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছি এঁকে বেঁকে। মন্ত্রমুগ্ধ-ও বোধহয় সঠিক ‘উপমা’ নয় এই অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার। আশেপাশের পরিবেশ শিহরিত করে তুলছিল প্রতিটি রোমকূপকে। চূড়ান্ত নিস্তবতা আর বুকের ধুকপুকানি জানান দিচ্ছিল অজানা আতঙ্ককে। বেশ কিছুক্ষনের শান্ত পরিবেশ ভেঙে পাখির কিচির মিচির আর ঝিঁঝিঁর ডাক কিছুটা অবাকই করল আমাদের। আঁধারঘন সেই রাস্তা অতিক্রম করে আবার আলোয় ফিরলাম আর তখনই কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই থেমে গেল আমাদের গাড়ি।

The hill path in the silent dark foggy Pine forest in Neora Valley - Rishop - Kalimpong - Abakash images

গাড়ি থেকে যেখানে নামলাম সেটি অত্যন্ত নির্জন। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত স্থানটির চারপাশ ঘন জঙ্গলে মোড়া। সেখান থেকে মসৃন পিচে ঢাকা একটি রাস্তা নেমে গিয়েছে নিচের দিকে। আশেপাশে কোন ঘরবাড়ি তো দূরস্থান কোন লোকজনও চোখে পড়ল না। পান্ডব বর্জিত স্থান বলতে যা বোঝায় এটিও তাই। একটানা ঝিঁঝিঁর ডাকে স্থানটির নির্জনতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। গাড়ি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার থেকে একটু এগোলে পাথর বাঁধানো একটি জায়গা। তার ঠিক নিচে ঘন জঙ্গলাবৃত চড়া খাদ। খাদের ওপারের দৃশ্য গোচরে আসছিল না ঘন কুয়াশায়। বেশ কিছুটা হতাশ আমরা সকলেই; এটি কিভাবে একটি দর্শনীয় স্থান হতে পারে সেটিও ঠিক বোধগম্য হল না।

আমাদের মনের অবস্থা বুঝে সদন জানাল, এটি একটি কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ পয়েন্ট, আজ আবহাওয়া খারাপ তাই তার রূপ থেকে আমরা বঞ্চিত। এই পাহাড়ের নিচে যে গ্রামটি সেটিও খুব সুন্দর; হাতে আরও ঘন্টা দেড়েক সময় আছে চাইলে আমরা ওখান থেকে ঘুরে আসতে পারি। ওর পারমিট নেই তাই এর বেশি আর এগোতে পারবে না।

পাইন, ঝাউ ছাড়াও চিরহরিৎ শিমুল, বয়েড়া, হরিতকী ও নাম না জানা পাহাড়ি ফল-ফুলের গাছে মোড়া নির্জন পাহাড়ি রাস্তা। হরেক প্রজাতির অর্কিডও ঝুলে রয়েছে গাছের শাখা প্রশাখায়। পাখির কিচিরমিচির আর ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা নেমে চললাম নিচে। হঠাৎ খট খট শব্দে কিছুটা চমকে উঠে, হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম আসন্ন বিপদের। মনে কিছুটা সাহস এনে একটি বাঁক ঘুরতেই দেখলাম আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে পুরু লোমষ একটি গরু। আর বেশ কিছুটা তফাতে মাথায় জংলী লতা পাতা বোঝাই করা তার মালিক। আমাদের পাশ কাটিয়ে উঠে যেতে থাকল তারা।

কিছুটা নেমে আসার পর ঝিঁঝিঁর ডাক চাপা পড়ে গেল পাখির কাকলিতে। গাছে গাছে ফুটে রয়েছে নাম না জানা অজস্র সাদা, লাল, খয়েরি, বেগুনী ফুল। একটি যাত্রীবাহী গাড়ি মাথাভর্তি সওয়ারি নিয়ে হেলেদুলে পাশ কাটিয়ে নেমে গেল নিচে। আরও কত পথ হাঁটলে যে পৌঁছানো যায় সে গ্রামে তার হিসাব নেই আমাদের। তাই সকলে ফিরতে চাইল, অগত্যা ফিরতে হল গাড়িতে।

এবার ফেরার পালা… রিশপ আমাদের কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনে বাধা দিলেও তার শান্ত শীতল পরিবেশ মুদ্ধ করেছে আমাদের। একে একে গাড়িতে উঠল সকলে। মন তখন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় বুঁদ। আরও রোমাঞ্চ পেতে উদগ্রীব সে। ঠিক করলাম হেঁটেই নামব নিচে। জন মানবহীন সেই প্রাচীন জঙ্গলের অচেনা রাস্তায় আমাকে সঙ্গদিতে বা একা ছাড়তে নারাজ সকলে। কিন্তু জেদ তখন চেপে বসেছে মাথায়, কিছুতেই ফিরবনা গাড়িতে। শেষে শোভন নেমে এল গাড়ি থেকে।

Man Walking Through Dark Oak-Pine Forest in Neora Valley National Park, Lava, Rishop, Kalimpong, West Bengal - Abokash images

ঘন জঙ্গল যেন গিলে নিল আমাদের। সুপ্রাচীন জঙ্গলে আমরা যেন মিলিয়ে গেলাম নিমিষে। পড়ন্ত আলোয় অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই পাইন আর ঝাউয়ের জঙ্গলের রাস্তায় খচমচ করে নামতে থাকলাম দুই বন্ধু। বহু যুগের সাক্ষী হয়ে থাকা বৃক্ষগুলির বাদামী কাণ্ডের প্রায় পুরোটাই ঘন শ্যাওলায় ঢাকা। তাদের গাঢ় সবুজ পাতায় ঢাকা শাখা প্রশাখা গুলি গম্বুজের মত সরু হয়ে উঠে গেছে অনেক ওপরে। যেখানে এখনো লেগে আছে শেষ বেলার সূর্যের অন্তিম ছটা।

কালো ঘন নিস্তব্ধ সেই জঙ্গলের মধ্যে এবড়ো খেবড়ো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল কেউ বুঝি পিছু নিয়েছে আমাদের। এই জঙ্গল হিমালয়ান ভল্লুকের বিচরণ ভূমি। যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে গাছের ওপর থেকে? আমরা দুজন সাথে দুটি ক্যামেরা ছাড়া আত্ম্যরক্ষার্থে আর কিছুই নেই সাথে। গা ছম ছম করে উঠতে লাগল বারবার। দিনের আলো ফুরিয়ে আসছিল অনেকটা পথ ফিরতে হবে, তাই পাচালালাম দুজনে। ভয় করলেও এই অনন্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে পেরে আমি অবিভুত, আমি তৃপ্ত।

নিচে অপেক্ষা করছিল সকলে, আমরা পৌঁছতেই গাড়ির আবার চলা শুরু। ভারাক্রান্ত মনে অনেক স্মৃতি নিয়ে ফিরে চলেছি তখন। গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আদিম অরণ্যানী বেষ্টিত শৃঙ্গগুলি পিছিয়ে পড়ছিল ক্রমাগত। আর ধূসর কুয়াশায় অস্পষ্ট চূড়ার পিছন থেকে ফিকে আলোর শেষকণা ছড়াতে ছড়াতে রক্তিম সূয্যিমামা মুচকি হেসে বিদায় জানাচ্ছিল আমাদের।

 

 

– সমাপ্ত –

The golden-blue idols of Lord Buddha with His companion giving blessings at Kagyu Thekchen Ling Monastery - Lava, Beautiful Bengal - Abakash images
আমাদের প্যাকেজ ট্যুর

Leave a Reply

Proceed Booking