নীল আকাশ, ঘন সবুজ বনানী-বিস্তৃত গিরিরাজের পাদদেশে অবস্থিত ডুয়ার্সের স্বল্পপরিচিত এই স্থানটি চমৎকার একটি ট্যুরিস্ট স্পট। নেওড়া ভ্যালির গহন অরণ্য এখানে এসে মিশেছে সমতলের সাথে। ছোট বড় চাবাগান ও ঘন জঙ্গলে মোড়া উঁচু-নিচু পাহাড় পরিবেষ্টিত স্থানটি মনে ও প্রাণে ভরে দেয় মুক্ত সতেজ প্রাণবায়ু।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ৩০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত সানতালেখোলা। নুড়ি-পাথরের মাঝ দিয়ে বয়ে আসা ছোট্ট নদী মূর্তি ও তার ওপরে কাঠের পাটাতনবেষ্টিত একটি ঝুলন্ত সেতু, এই পাড়ের সাথে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে অন্য পাড়কে। সেতু পার হয়ে রাস্তা গিয়েছে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘন জঙ্গলের পাশ দিয়ে। সেটি ধরে একটু এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে বেঁকে গেলেই যাত্রাপথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের মূল ফটক। আপনার সর্বক্ষণের সঙ্গী এখানে মূর্তি নদী ও উঁচু পাহাড় থেকে ঢাল বেয়ে নেমে আসা ঘন জঙ্গলের গাছে গাছে উড়ন্ত পাখিরা। নদীর স্রোতে গড়িয়ে আসা নুড়ির ওপর বসে; ঝিঁঝিঁ ও পাখির কিচিরমিচির এবং মূর্তির কুলকুল শব্দের কোরাস শুনতে শুনতে স্নিগ্ধ পরিবেশে জঙ্গলের শোভা দেখে কাটিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় অনেকটা সময়।
পাহাড় ও জঙ্গলের মেলবন্ধন যুক্ত এ স্থান প্রকৃতি এবং পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বিশেষত বন-কপোত, রেড-ভিন্টেড বুলবুলি, হরেক রঙের ফিঙে, হিমালয়ান ঈগল, বন মোরগ, গ্রীন ম্যাগপাই, গ্রে-গোল্ড ট্রিপাই, ফ্যানটেল, স্কারলেট-মিনিভেট, হর্নবিল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
দূষণ আর কোলাহলের থেকে শত ক্রোশ দূরে, বনবাংলোয় বসে অলস সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা চমকপ্রদ। এলাচ ও চায়ের গন্ধমাখা প্রকৃতির সৌন্দর্যকে দেখতে এবং নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে সানতালেখোলা এককথায় অনবদ্য।
সানতালেখোলা থেকে একই রুটে দেখে নেওয়া যায় সামসিং (৪ কিমি), রকি আইল্যান্ড (৫ কিমি), ঝালং (২৩ কিমি), প্যারেন (৩১ কিমি) এবং বিন্দু (৩৪ কিমি)। সারাদিনের জন্য গাড়িভাড়া পড়বে ১৫০০-১৮০০ টাকা।
এছাড়াও এখান থেকে ঘুরে আসা যায় একই রুটে: চাপড়ামারি ফরেস্ট (২৮ কিমি), গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক (৩০ কিমি)। সারাদিনের জন্য গাড়িভাড়া পড়বে ২৫০০-৩০০০ টাকা।
ঋতুপরিবর্তনের সাথে সাথে সুনতালেখোলার অপার সৌন্দর্যের বদল ঘটে। গ্রীষ্মের তাপদাহের আঁচ না লাগলেও মূর্তির কুলকুল শব্দের সাথে পাখপাখালির কিচিরমিচিরে মুখরিত হয় চারপাশ। বর্ষায় বারিধারায় পুষ্ট সরু নদীই রুদ্রমুর্তি ধারণ করে ঝমঝমিয়ে লাফিয়ে চলে নিচে। ঝাউ, দেবদারু, মেহগিনি, অর্জুন, জাম, কমলালেবুর হালকা-ঘন চিরহরিৎ জঙ্গলের বর্ষাস্নাত দৃশ্য অবর্ণনীয়। শীত ও বসন্তে ফুলে ফলে ভরা গাছে উড়ে বেড়ায় রং-বেরঙের প্রজাপতি ও মৌমাছি। কমলালেবু ফুলের সুবাস নিতে নিতে কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের চূড়াগুলি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে একচিলতে রোদের আশায়। প্রত্যেক ঋতুই তার সুস্পষ্ট ছাপ ফেলে রেখে যায় এখানে। তাই বছরের যে কোন সময়ই সুনতালেখোলা স্বাগত জানায় সকলকে।
রাত্রিবাস করার জন্য এখানে আধুনিক সুবিধাযুক্ত বাংলো টাইপের দু-তিনটি বাড়ি এবং স্থানীয় মানুষদের ব্যবস্থাপনায় কিছু হোমস্টেও রয়েছে। এছাড়াও রাত কাটানোর জন্য রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ছোট ছোট অনেকগুলি আধুনিক সুবিধাযুক্ত কটেজ। আগে থেকে বুক করে যেতে হয় নতুবা ঘর খালি থাকলেও এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। এক রাত্রি থাকার খরচ ২০০০-৩০০০ টাকা।
যে রিসর্ট/হোমস্টে বুক করবেন তারাই খাবার পরিবেশন করেন। খুব ছোট জনপদ হওয়ায় চাইলেও বাইরে খাবারের বিশেষ ব্যবস্থা নেই। কাছাকাছির মধ্যে প্রায় ২ কিমির মধ্যে আছে সামসিং বাজার, দু একটি ছোট রেস্তোরাঁ ও হোটেল আছে। এখানকার মোমো এবং নুডুলসের স্বাদ বেশ ভালো।
কাঠের তৈরী ঘর সাজানোর জিনিসের বিপুল সম্ভার নিয়ে হাজির ডুয়ার্স। সেগুলি কেনার জন্যে অবশ্য সামসিং বাজারে আসতে হবে। এখানকার বিশেষ আকর্ষণ হল পার্শ্ববর্তী বাগানের ভিন্ন স্বাদের টাটকা তাজা চা। ফেরার আগে অবশ্যই কিছু চায়ের প্যাকেট পকেটস্থ করতে ভুলবেন না।